অনলাইন ডেস্ক – দেখতে দেখতে চলে গেলো আরো একটি বছর। ২০১৮ সালে শেষে আমরা এখন ২০১৯ সালে। জীবনের চিরায়ত নিয়মে এবছর আমাদের বিদায় জানাতে হয়েছে বিভিন্ন ক্ষেত্রে অবদান রাখা বেশ কজন গুনীজনকে। সেইসব বরেণ্য মানুষ স্মরণ করা যাক।
শাম্মী আক্তার
ঢাকা শহর আইসা আমার আশা পুরাইছে’, ‘ঝিলমিল ঝিলমিল করেছে রাত’- এমনই অনেক গানের জনপ্রিয় কণ্ঠশিল্পী শাম্মী আক্তার মারা যান এবছর ১৬ জানুয়ারি । দীর্ঘদিন ধরেই তিনি মরণব্যাধি ক্যান্সারে ভুগছিলেন। স্বাধীন বাংলাদেশের আগেই শিল্পী হিসেবে তার যাত্রা শুরু হলেও স্বাধীনতার পর পান জনপ্রিয়তা। তখনকার রেডিওতে খুব শোনা যেত তার গান। একটা সময়ে তিনি নিজেকে চলচ্চিত্রের গান নিয়েই বেশি ব্যস্ত থেকেছেন। দীর্ঘ ক্যারিয়ারে শাম্মী আক্তার সিনেমার জন্য গেয়েছেন তিন শতাধিক গান।
শওকত আলী
২০১৮ সালের ২৫ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন কথাসাহিত্যিক, সাংবাদিক ও শিক্ষাবিদ শওকত আলী। তার দক্ষিণায়নের দিন, কুলায় কালস্রোত এবং পূর্বরাত্রি পূর্বদিন যেগুলোকে ত্রয়ী উপন্যাস বলা হয়, যার জন্য তিনি ফিলিপস সাহিত্য পুরস্কার (১৯৮৬) লাভ করেন। তিনি বিংশ শতাব্দীর শেষভাগে স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে গল্প ও উপন্যাস লিখে খ্যাতি অর্জন করেন। ১৯৯০ সালে সাহিত্যে অবদানের জন্য বাংলাদেশ সরকার তাকে একুশে পদকে ভূষিত করে।
ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণী চলতি বছর ৬ মার্চ রাজধানীর ল্যাবএইড হাসপাতালে মারা যান ফেরদৌসি প্রিয়ভাষিণী। জনসম্মুখে প্রথম নিজেকে ‘বীরাঙ্গনা’ হিসেবে পরিচয় দেন এই নারী। স্বাধীনতাযুদ্ধে তার এই ত্যাগ স্বীকারের অবদান হিসেবে বাংলাদেশ সরকার ২০১৬ সালে তাকে তাঁকে মুক্তিযোদ্ধা খেতাব দেয়। এর আগে ২০১০ সালে তিনি বাংলাদেশের সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মান স্বাধীনতা পদক পান। ব্যতিক্রমী এক ভাস্কর্যশিল্পী হিসেবেও ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণীর ছিল আলাদা পরিচয়। ঝরা পাতা, মরা ডাল, গাছের গুড়ি দিয়েই মূলত তিনি গৃহের নানা শিল্প কর্মে তৈরি করতেন।
বেলাল চৌধুরী
বাংলা সাহিত্যের অন্যতম খ্যাতিমান কবি, প্রাবন্ধিক, অনুবাদক ও সাংবাদিক বেলাল চৌধুরী এ বছরের ২৪ এপ্রিল রাজধানীর ধানমণ্ডির আনোয়ার খান মডার্ন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন মারা যান। দীর্ঘদিন ধরে তিনি কিডনি, ডায়বেটিসসহ বার্ধক্যজনিত রোগে ভুগছিলেন। তার উল্লেখযোগ্য কাব্যগ্রন্থ হল ‘নিষাদ প্রদেশে’, ‘আত্মপ্রতিকৃতি’, ‘স্থিরজীবন ও নিসর্গ’, ‘স্বপ্নবন্দী’, ‘সেলাই করা ছায়া’, ‘কবিতার কমলবনে’, ‘যাবজ্জীবন সশ্রম উল্লাসে’ ও ‘বত্রিশ নম্বর’। বাংলা সাহিত্যে অবদানের জন্য পেয়েছেন একুশে পদকও।
মুস্তাফা নূরউল ইসলাম
লেখক, গবেষক, ভাষাসৈনিক ও বাংলাদেশের জাতীয় অধ্যাপক মুস্তাফা নূরউল ইসলাম মারা যান ২০১৮ সালের ৯ মে। সাহিত্য-সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের পাশাপাশি বাম ধারার রাজনীতির সঙ্গে সংযোগ ও ভাষা আন্দোলনে অংশগ্রহণ তাঁর চিন্তা ও কর্মে সুদূরপ্রসারী প্রভাব রেখেছে। তাঁর কর্মজীবন বিচিত্র, বর্ণাঢ্য। সাংবাদিকতা করেছেন। শিক্ষকতা করেছেন সেন্ট গ্রেগরিজ কলেজ, পাবনা এডওয়ার্ড কলেজ, করাচি বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ও লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ে। ২০১১ সালে তাকে জাতীয় অধ্যাপক হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়। তার প্রকাশিত গ্রন্থ সংখ্যা প্রায় অর্ধশত। তিনি একুশে পদকও লাভ করেন।
তাজিন আহমেদ
ছোটপর্দার জনপ্রিয় অভিনেত্রী তাজিন আহমেদ ২২ মে রাজধানীর একটি হাসপাতালে মারা যান। হৃদরোগে আক্রান্ত হলে তাকে উত্তরার রিজেন্ট হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সেখানেই তাকে লাইফ সাপোর্ট দেওয়া হয়। তবে তাকে আর ফেরানো যায়নি।
রানী সরকার
২০১৮ সালের ৭ জুলাই চলচ্চিত্র অভিনেত্রী রানী সরকার রাজধানীর একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান। ৭০ দশকে খল চরিত্রে অভিনয় করে ব্যাপক জনপ্রিয়তা পান এই শিল্পী। জীবনের শেষভাগে আর্থিক অনটনে পড়ে বড় কষ্টের সঙ্গে দিন কাটিয়েছেন তিনি।
গোলাম সারওয়ার
দেশের খ্যাতিমান সাংবাদিক ও সম্পাদক গোলাম সারওয়ার সিঙ্গাপুরে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ২০১৮ সালের ১৩ আগস্ট তিনি মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর সাংবাদিকতার জীবন শুরু হয় ১৯৬৩ সালে দৈনিক পয়গম দিয়ে। এরপর তিনি যুক্ত ছিলেন দৈনিক সংবাদ, দৈনিক ইত্তেফাক, দৈনিক যুগান্তর, দৈনিক সমকালের মতো শীর্ষস্থানীয় দৈনিকে। তিনি ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন। ২০১৪ সালে বাংলাদেশ সরকার দেশের সাংবাদিকতায় অবদানের জন্য তাকে দেশের সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মান একুশে পদকে ভূষিত করে। তাঁর প্রকাশিত গন্থের মধ্যে ছড়াগ্রন্থ রঙিন বেলুন এবং প্রবন্ধ সংকলন সম্পাদকের জবানবন্দি, অমিয় গরল, আমার যত কথা, স্বপ্ন বেঁচে থাক উল্লেখযোগ্য।
রমা চৌধুরী
একাত্তরের বীরাঙ্গনা রমা চৌধুরী ২০১৮ সালের ৩ সেপ্টেম্বর চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেন । ১৯৭১ সালে তিনি পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর হাতে নিজ বাড়িতে নির্যাতনের শিকার হন। তিনি তার ওপর নির্যাতনের ঘটনা একাত্তরের জননী নামক গ্রন্থে প্রকাশ করেন। স্বাধীনতার পরে ২০ বছর তিনি লেখালেখিকে পেশা হিসেবে বেছে নেন। প্রবন্ধ, উপন্যাস ও কবিতা মিলিয়ে তার ১৮টি গ্রন্থ প্রকাশ হয়েছে।
আইয়ুব বাচ্চু
২০১৮ সালের ১৮ অক্টোবর রূপালি গিটারের রাজপুত্র ব্যান্ডতারকা আইয়ুব বাচ্চু মারা যান। তিনি ছিলেন একাধারে গায়ক, গিটারবাদক, গীতিকার, সুরকার, ও চলচ্চিত্রে প্লেব্যাক শিল্পী ছিলেন। এলআরবি ব্যান্ড দলের লিড গিটারবাদক এবং ভোকাল বাচ্চু ছিলেন বাংলাদেশের ব্যান্ডসঙ্গীত জগতের জনপ্রিয় ও সম্মানিত ব্যক্তিত্বদের একজন। সঙ্গীতজগতে তার যাত্রা শুরু ফিলিংস ব্যান্ড দলের মাধ্যমে ১৯৭৮ সালে। তিনি তার শ্রোতা-ভক্তদের কাছে ‘এবি’ নামেও পরিচিত। মূলত রক ঘরানার কণ্ঠের অধিকারী হলেও আধুনিক গান, শাস্ত্রীয় সঙ্গীত এবং লোকগীতি ঘরানায়ও তিনি কাজ করেছেন।
তরিকুল ইসলাম
বিশিষ্ট রাজনীতিবিদ তরিকুল ইসলাম মারা যান গত ৪ নভেম্বর । তিনি ছিলেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য। যশোর থেকে চারবার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন সাবেক এ মন্ত্রী।
তারামন বিবি
মুক্তিযুদ্ধে রণক্ষেত্রে সাহসিকতা ও বীরত্বপূর্ণ অবদানের জন্য বীরপ্রতীক উপাধি পাওয়া তারামন বিবি ১ ডিসেম্বর নিজ বাসায় মৃত্যুবরণ করেন। তারামন বিবি ১১নং সেক্টরে নিজ গ্রামে আবু তাহেরের নেতৃত্বে অংশ নেন। মুহিব হাবিলদার নামে এক মুক্তিযোদ্ধা তারামন বিবিকে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেয়ার জন্য উৎসাহিত করেন। তখন তারামনের বয়স ছিল মাত্র ১৩ কিংবা ১৪ বছর।
আনোয়ার হোসেন আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন আলোকচিত্রী আনোয়ার হোসেন ২০১৮ সালের ১ ডিসেম্বর মারা যান। ঢাকার একটি হোটেল থেকে তার মরদেহ উদ্ধার করা হয়।অসাধারন চিত্রগ্রহণের জন্য তিনি পাঁচবার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পেয়েছেন।
আমজাদ হোসেন
অভিনেতা, লেখক এবং চলচ্চিত্র পরিচালক আমজাদ হোসেন ২০১৮ সালের ১৪ ডিসেম্বর ৭৬ বছর বয়সে ব্যাংককের বামরুনগ্রাদ হাসপাতালে মৃত্যুবরণ করেন। খ্যাতিমান এই নির্মাতা পরিচালিত প্রথম চলচ্চিত্র আগুন নিয়ে খেলা মুক্তি পায় ১৯৬৭ সালে। পরে তিনি নয়নমণি, গোলাপী এখন ট্রেনে, ভাত দে দিয়ে প্রশংসিত হন। কর্মজীবনে ১২টি জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার অর্জনে করেন তিনি। শিল্পকলায় অবদানের জন্য বাংলাদেশ সরকার তাঁকে ১৯৯৩ সালে একুশে পদকে ভূষিত করে। এছাড়া সাহিত্য রচনার জন্য তিনি ১৯৯৩ ও ১৯৯৪ সালে দুবার অগ্রণী শিশু সাহিত্য পুরস্কার ও ২০০৪ সালে বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কারসহ একাধিক পুরস্কার লাভ করেন।
সাইদুল আনাম টুটুল
২০১৮ সালের ১৫ ডিসেম্বর হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে রাজধানীর ল্যাবএইড হাসপাতালে মারা যান সাইদুল আনাম টুটুল। তিনি চলচ্চিত্র সম্পাদক হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন। ১৯৭৯ সালে শেখ নিয়ামত আলী পরিচালিত ‘সূর্য দীঘল বাড়ী’ চলচ্চিত্রের সম্পাদনার জন্য টুটুল জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার লাভ করেন। এছাড়াও, ‘ঘুড্ডি’, ‘দহন’, ‘দীপু নাম্বার টু’ এবং ‘দুখাই’ ছবির সম্পাদনাও করেছিলেন তিনি।
চিত্রকর সৈয়দ জাহাঙ্গীর
একুশে পদক প্রাপ্ত প্রখ্যাত প্রথিতযশা চিত্রকর সৈয়দ জাহাঙ্গীর। তিনি ২৯ ডিসেম্বর সকাল ১১টায় রাজধানীর মোহাম্মদপুরের ইকবাল রোডের বাসভবনে মৃত্যুবরণ করেন। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৮৭ বছর।
প্রতিদিনের খবরগুলো আপনার ফেসবুক টাইমলাইনে পেতে নিচের লাইক অপশনে ক্লিক করুন-